“পার্বত্য জেলা কে একটা সময় বাংলাদেশের কাজু বাদাম ও কফির জেলা বলা হবে”
পার্বত্য উপদেষ্টা, সুপ্রদীপ চাকমা।
পাহাড়ের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে কাজু ও কফির চাষাবাদ।বর্তমান সময়ে বিশ্ববাজারের চাহিদা অনুযায়ী ৬ বিলিয়ন ডলারের কাজুবাদামের বাজার আর বাংলাদেশের বাজারে এর চাহিদা আছে ৭শত কোটি টাকা।দেশীয় বাজারে বছরে কফির চাহিদা আছে ২ হাজার টন,প্রতি বছর প্রায় ৬শত কোটি টাকার কফি দেশীয় বাজারে বিক্রি হয়।
প্রতি বছরি দেশীয় বাজারে বাড়ছে কাজুবাদাম ও কফির চাহিদা,সাথে সথে বাড়ছে এই শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রতিষ্ঠান যেখানে সৃষ্টি হচ্ছে হাজারো বেকারদের কর্মসংস্থান।
একটা সময় দেশীয় বাজারে কাজুবাদামের চাহিদার শতকরা ৯৫ ভাগই পূরন হয়েছে আমদানির উপর,তবে সময়ের সাথে সাথে দেশীয় বাজারের এই চাহিদা পূরন করতে নানাবিধ কৃষি উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণে উদ্যোগ নেয় সরকার।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদনে দেয়া তথ্য অনুযায়ী সরকার কাজুবাদাম ও কফির চাষাবাদ বৃদ্ধি ও দেশের স্থানীয় চাহিদা পূরন করে বিদেশে রপ্তানি ও স্থানীয় কর্মসংস্থান বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজুবাদাম ও কফি গবেষণা,উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ প্রকল্পের অধিনে ২০২১ সাল হতে ২০২৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত(প্রকল্পের মেয়াদ শেষ) দেশের ১৯ টি জেলার ৬৬ টি উপজেলা,৩০ টি হার্টিকালচার সেন্টারের মাধ্যমে ১৫৮ কোটি ৫৪ লাখ টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে।
তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে পার্বত্য জেলা বান্দরবানেও এখন বেড়েছে কাজু ও কফির আবাদ।এই অঞ্চলের ভূ-প্রকৃতি, আবহাওয়া ও জলবায়ু কাজুবাদাম ও কফি চাষাবাদের জন্য সবচেয়ে উপযোগী বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয় ও বিশেষজ্ঞরা।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয়ের দেয়া তথ্য অনুযায়ী ২০২০-২১ অর্থবছরে ৮শত হেক্টর জমিতে কাজু বাদাম চাষ হলেও বর্তমানে জেলায় ৩ হাজার হেক্টর জমিতে কাজুবাদামের চাষ হচ্ছে, আর কফির চাষকৃত জমি ৪শত হেক্টর থেকে বৃদ্ধি পয়ে ১ হাজার হেক্টরে উন্নিত হয়েছে।
কাজুবাদাম ও কফি চাষ লাভজনক হওয়ায় পূর্বের যে কোন সময়ের চেয়ে বর্তমানে এর চাষাবাদ বেড়েছে ব্যাপক হারে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা ইতিমধ্যেই অনগ্রসর পাহাড়ী কৃষকদের আত্মকর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক ভাবে স্বাবলম্বী হতে পার্বত্যাঞ্চলে কফি ও কাজু বাদাম চাষাবাদের জন্য কৃষকদের পরামর্শ দিয়েছেন।তিনি জানান সিলেটকে যেমন চা-পাতার জেলা বলা হয় তেমনি একদিন তিন পার্বত্য জেলা কাজুবাদাম ও কফি চাষাবাদের জন্য বাংলাদেশে সমাদৃত হবে।লাভজনক বিবেচনা করে কফি ও কাজুবাদাম চাষকে প্রাধান্য দিচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়।
মন্ত্রণালয়ের অধিভূক্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড,জেলা পরিষদ ও স্থানীয় কৃষি বিভাগকে পাহাড়ের কৃষকদের আত্মকর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক ভাবে স্বাবলম্বী করার লক্ষ্যে কৃষকদের কফি ও কাজুবাদামের চারা বিতরণ সহ স্থানীয় কৃষক-কৃষানীদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে।
২০২১সালে কফি-কাজু বাদাম চাষ প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু হয়। প্রকল্প কার্যক্রম বাস্তবায়নের ফলে বর্তমানে প্রায় ৪২০০ হেক্টর জমিতে কাজুবাদাম চাষাবাদ হচ্ছে।
একই সাথে পূর্বে শুধুমাত্র ৬৫ হেক্টর জমিতে কফি চাষাবাদ করা হতো, বর্তমানে ১৮০০ হেক্টর জমিতে উন্নীত হয়েছে কফির চাষাবাদ।
পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে তিন পার্বত্য জেলার ১২ টি উপজেলায় প্রায় ২ হাজার কফি ও কাজুবাদামের বাগান সৃজন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের সদস্য ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের কফি ও কাজু বাদাম চাষের মাধ্যমে দারিদ্র হ্রাসকরণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক কৃষিবিদ মোঃ জসিম উদ্দিন।
তিনি জানান, পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে পার্বত্য চট্টগ্রামের অনাবাদি জমিতে কাজুবাদাম ও কফি চাষ সম্প্রসারিত প্রকল্প কার্যক্রম পরিচালনা করছে উন্নয়ন বোর্ড।
উৎপাদিত পণ্যের দাম বৃদ্ধির ফলে পার্বত্য এলাকার মানুষ কাজুবাদাম ও কফি চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছে।
কৃষিবিদ মোঃ জসিম উদ্দিন জানান, পার্বত্য এলাকায় যেখানে পরিকল্পিত ও ফাঁকা স্থানযুক্ত ফলবাগান রয়েছে সেখানে অনায়াসে কফি বাগান করা যায়। বাগানে সেচ সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে আম, মাল্টা, কাঁঠাল, কমলা, কলা, আনারসের পাশাপাশি একই বাগানে কফি চাষেও সাফল্য মিলছে।
আর এটাই কফিতে কৃষকের আগ্রহের মূল কারণ।সবচেয়ে আশার কথা হলো “বাংলাদেশের তিন পার্বত্য জেলায় প্রায় পাঁচ লাখ হেক্টর অব্যবহৃত জমি রয়েছে।
এর মধ্যে এক লাখ হেক্টরে কফি চাষ করলে দুই লাখ টন কফি উৎপাদন সম্ভব”। পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড পাহাড়ে বর্তমানে প্রায় ২ হাজার কফি-কাজুবাদামের বাগান সৃজিত করেছে স্থানীয় কৃষকদের মাধ্যমে। দেশে উৎপাদিত কাজুবাদাম ও কফির মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি ১ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব।
পার্বত্য অঞ্চলের ২ লাখ হেক্টর অনাবাদি পাহাড়ি জমিকে কাজুবাদাম ও কফি চাষের আওতায় আনার কাজ চলমান রয়েছে।
এদিকে দেশের বাজারে কাজুবাদামের ভোক্তা পর্যায়ে চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। ইতোমধ্যে দেশে ২২টি প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা গড়ে উঠেছে। দেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলে বড় শিল্পগোষ্ঠীর প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা স্থাপন করছে।বিএসআরএম ও কাজী গ্রুপের মতো প্রতিষ্ঠান রপ্তানির উদ্দেশ্যে প্রায় ২৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা স্থাপন করছে।
এসব কারখানায় প্রায় ১২০০ জনের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।এছাড়াও প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানাগুলোতে প্রায় ২০০০ জন নারী শ্রমিকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে।
তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে বান্দরবানে প্রথম কফি ও কাজুবাদামের প্রসেসিং কারখানা গড়ে উঠেছে,”কিষান ঘর” নামের এই প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী মোঃ তারিকুল ইসলাম জানান কাজুবাদাম ও কফি চাষাবাদের সাথে ৫-৬ হাজার কৃষক জড়িত,বছর ব্যাপী বাগানের পরিচর্যার জন্য কৃষকরা কোন আর্থিক প্রতিষ্ঠান হতে স্বল্প সুধে কৃষি ঋন পায় না,যা এই সেক্টরের জন্য একটি বড় প্রতিবন্ধকতা।সরকারের পক্ষ হতে যদি কৃষকদের যদি কৃষি ঋনের ব্যাবস্থা করা যায় তাহলে এই অঞ্চলে কাজুবাদাম ও কফির উৎপাদন সক্ষমতা আরো বাড়বে।তিনি জানান কাগজে কলমে সকল ব্যাংকিং সেক্টরে কৃষি ঋনের কথা বলা থাকলেও বাস্তবিকতায় পার্বত্য এলাকায় এই সেক্টরে প্রসেসিং প্রতিষ্ঠানের জন্য কোন ঋনের সুযোগ নেই।তিনি জানান এ বছর চাষিরা কাজুবাদাম মন প্রতি ৭-৮ হাজার টাকা পেয়েছেন। বর্তমানে চাষিদের মাঝে চাষাবাদের যে আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে,এই ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে আগামী ৫-১০ বছরের মধ্যে আমরা দেশের বাজারে কাজুবাদাম ও কফির যে আাহিদা তা নিজেদের এর উৎপাদন দিয়ে পূরণ করতে সক্ষম হবো।আমদানির উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে দেশে এই সেক্টরের দিকে সুদৃষ্টি দেয়ার আহবান জানান সরকারের কাছে।
এদিকে কফি ও কাজু বাদাম কৃষি পণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণে ৩০০ উদ্যোক্তাকে পার্টনার প্রকল্পের অধিনে উন্নত প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর।
বিষয়টি নিশ্চিত করে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের সিনিয়র কৃষি বিপনন কর্মকর্তা শাহ্ মোঃ খোরশেদ কাদের বলেন এখন পর্যন্ত ৫০ জন উদ্যোক্তাকে উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যাবস্থা করা হয়েছে,২০২৮ সালের মধ্যে আমরা ৩শত জন উদ্যোক্তাকে পার্টনার প্রকল্পের অধিনে প্রশিক্ষণ সুবিধা প্রদান করবো।এছাড়া প্রসেসিং যন্ত্রাংশ, মেশিনারি কেনার জন্য শতকরা ৭০ ভাগ মেচিংগ্রেড প্রদান করছি।
কফি ও কাজুবাদাম চাষবাদের বিষয়ে , বান্দরবান কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক এম এম শাহ নেওয়াজ বলেন,পার্বত্য বান্দরবানের আবহাওয়া ও পরিবেশ কফি ও কাজু বাদাম চাষের যথেষ্ট উপযুক্ত,অর্থকরী ফসল হিসেবে কাজুবাদাম ও কফি চাষাবাদের জন্য আমরা পরামর্শ দিচ্ছি।
২০২০-২১ অর্থবছরে কাজু বাদাম ও কফি গবেষণা সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন প্রকল্পে শুরু হয় ১৯ টি জেলায়,যার মধ্যে বান্দরবানও অন্তর্ভুক্ত।এই প্রকল্পের আওতায় আমরা কৃষকদের ভিয়েতনাম থেকে আনা উন্নত কাজুবাদাম চারা এম২৩,এবং উন্নত জাতের এরাবিকা,রোবাস্টা জাতের কফি চারা প্রদান করেছি সাথে সার ও বালাইনাশক দেয়া হয়।
বান্দরবানে পূর্বে ৮ শত হেক্টর থেকে বেড়ে এখন ৩ হাজার হেক্টর জমিতে কাজুবাদাম চাষাবাদ হচ্ছে,পূর্বে কফি চাষ হতো ৪ শত হেক্টর জমিতে যা বর্তমানে ১ হাজারে উন্নিত হয়েছে।তিনি জানান কাজুবাদাম ও কফি অন্য ফলমূলের মতো পচনশীল না,কৃষকরা এসব শুখিয়ে সংরক্ষণ করে রাখতে পারবে এবং নিজেদের সুবিধাজনক সময়ে বাজারজাত করতে পারবে।পার্বত্য অঞ্চলের জন্য উপযুক্ত ও লাভজনক কৃষি হিসেবে কফি ও কাজুবাদাম চাষ হতে এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির একটি নতুন দার।
এদিকে ব্যাপক অর্থনৈতিক সম্ভাবনার কথা থাকলেও প্রয়োজনীয় লোকবলের অভাব ও স্থানীয় পাহাড়ি কৃষকদের অসচেতনতার কারনে সঠিক সময়ে সময়োগযোগি হয়ে উঠছেনা বাগানগুলো।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, তিন পার্বত্য জেলায় প্রায় ২ হাজার বাগান রক্ষণাবেক্ষণে রয়েছে মাত্র ৬ জন মাঠ সংগঠক যাদের নেই কোনো ডিপ্লোমা ডিগ্রি। যার ফলে চারা রোপন, রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্যা সময়মতো সম্ভব হচ্ছে না।এছাড়াও দক্ষ প্রশিক্ষকের অভাবে স্থানীয় পাহাড়ি জনগোষ্ঠিদেরকে সময়োপযোগি প্রশিক্ষণও দেওয়া যাচ্ছে না। যার ফলে অর্থনৈতিক ব্যাপক সম্ভাবনাময় কফি-কাজুবাদাম চাষ এখনো পর্যন্ত পাহাড়ে ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়ছেনা।যার কারনে পার্বত্য অঞ্চলে এই সেক্টরের জন্য প্রকল্প বরাদ্দের ৪১ কোটি টাকার অর্ধেক টাকা ব্যাবহার না করেই কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ক্রমে ২০ কোটি ৫০ লাখ টাকা মন্ত্রণালয়ে ফেরত পাঠানোর কথা জানিয়েছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের সদস্য ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের কফি ও কাজু বাদাম চাষের মাধ্যমে দারিদ্র হ্রাসকরণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক কৃষিবিদ মোঃ জসিম উদ্দিন।